"); -->

Jun 26, 2015

ফাঁসুড়ে ডাকাত


|| ফাঁসুড়ে ডাকাত ||



(বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ছোট গল্প “ফাঁসুড়ে ডাকাত” অবলম্বনে ।)

তখন আমার বাইশ বছর বোধ হয়,
আমি তখন মাদুলির ফেরিওয়ালা  ।
কবিরাজের কাছে চাকরি করে,
ঘুচিয়েছিলাম সংসারেরই জ্বালা  ।

সাত্ত্বিক বামুন সাজতে হতো আমায়,
গেরিমাটিতে ছোপানো কাপড় পরে ।
পায়ে থাকতো ক্যাম্বিসেরই জুতো,
রুদ্রাক্ষের মালা ধারণ করে । 

বছর তিনেক সেই চাকরি করি,
ছেড়ে দিলাম ধকল সইল না ।
ছাড়ার আগে গিয়েছিলাম এক গ্রামে,
আদায় করতে না দেওয়া পাওনা । 

বর্ধমানের মাখনপুরে যেতে,
মেমারী থেকে হাঁটার রাস্তা ধরি ।
রাস্তায় কিছু উদরপূর্তি করে,
যেতে হবে সেথায় তাড়াতাড়ি । 

শুনে সবাই ভয় দেখিয়ে বলে,
ঠাকুরমশাই যাবেন না গো হোথা ।
ফাঁসুড়ে ডাকাত ঘাপটি মেরে থাকে,
শরীর থেকে কেটে নেবে মাথা । 

তবু আমায় যেতেই হবে সেথা,
বারণ আমি তাদের নাহি শুনি ।
সন্ধেবেলায় এক দিঘির কাছে এসে,
একা আমি মনে প্রমাদ গুনি । 

খুব বড় সেকেলে এক দিঘি,
দুই পারেতেই তালগাছের সারি ।
ডাকাত যদি আসে আমার কাছে,
উল্টোদিকেও দৌড় দিতে পারি । 

দূরে দেখি লিলি করছে গ্রাম,
ওই গ্রামটাই খুঁজছি আমি যাকে ।
ওটা নিশ্চয়ই সেই সঞ্জয়পুর,
কি ভয়টাই না দেখিয়েছিল লোকে । 

তখন আমার এটাই মনে হল,
মানুষ কেন মিথ্যে দেখায় ভয় ।
যেসব কথা বলেছিল ওরা,
এসে দেখি তেমন কিছুই নয় । 

হটাত দেখি এক বৃদ্ধ পিছন পানে,
আমার দিকেই আসছে মনে হয় ।
হাত নেড়ে সে আমায় যেন ডাকে,
কাছে এসে বললে সে আমায় । 

সাঁঝের বেলা যাবেন আপনি কোথা,
রাতের বেলায় একটু বিশ্রাম নিতে ।
চলুন না তবে আমার বাড়ির পানে,
যেথায় যাবেন পৌঁছে দেব প্রাতে । 

অসুবিধা কিছুই রাখব না যে,
চাল ডাল সব মজুত ঘরেতেই ।
একটুখানি পুণ্যি করার লোভে,
বামুন সেবা করে ধন্য হই । 

মনে হলো ভালোই হলো আমার,
ভগবান তো আছেই আমার সাথে ।
বৃদ্ধের নাম নফর চন্দ্র দাশ,
উঠলাম গিয়ে এক চণ্ডীমণ্ডপেতে । 

এক নাগাড়ে হটাত কুকুর ডাকে,
কেমন যেন অমঙ্গলময় ।
মনে হলো এলাম শ্মশানভূমে,
এটা কোন গৃহস্থ বাড়ি নয় । 

পরে দেখি বেশ অবস্থাপন্ন তিনি,
বাড়ির মধ্যে তিনটে ধানের গোলা ।
গোয়ালঘরে আছে কত গরু,
বাড়ির মধ্যে চারটে আটচালা । 

সেইখানেতে একটা ছোট্ট ঘরে,
থাকতে দিল আমায় যতন করে ।
চাল, ডাল, জল এনে দিল সবই,
বলল, স্বপাক রান্না নেবেন করে পরে । 

খানিক পরে সমুখ পানে দেখি,
ঝাঁটা হাতে আসছে একটি মেয়ে ।
মনে হলো বাড়িরই কোন বউ,
সামনে এসে চকিতে তাকায় চেয়ে । 

অপলকে তাকিয়ে আমার পানে,
ভাল লাগে না গণ্ডগ্রামে এসে ।
ব্যাপারটা মোর লাগছে না তো ভালো,
ঝামেলায় কি পড়ব অবশেষে । 

খানিক বাদে উঠান ঝাঁটা দিয়ে,
চলে গেল ভিতর বাড়ির দিকে ।
আমার পানে চায় যে ফিরে ফিরে,
ভাবি আমি, বলবে যা তা লোকে । 

মিনিট পাঁচেক পরেই আবার এলো,
মনে হল খুবই উত্তেজিত ।
নিচু স্বরে বললে আমার পানে,
আজ আপনার মৃত্যু নির্ধারিত । 

এরা হল ফাঁসুড়ে ডাকাত সব,
এখান থেকে পালান সুযোগ পেলে ।
চকিতে সে চলে গেল কোথা,
আচম্বিতে আমায় এ সব বলে । 

শুনে আমার হৃৎকম্প শুরু,
খুন্তি আমার রয়েই গেল হাতে ।
ভাবি গৃহস্থরা ডাকাত অবশেষে,
জীবন আমার শেষ হবে এই রাতে । 

কি করেই বা পালাই এখান থেকে, 
জানিনা তো গ্রামের কোন কিছু ।
ছেলেদের নিয়ে বৃদ্ধ দাওয়ায় বসে,
পালাতে গেলেই করবে কেটে কচু । 

মিনিট পাঁচেক পরেই বউটি আসে,
মনে ভাবি, দয়াময়ী তুমি ।
দাওনা বলে পালাই যে কিভাবে,
কি যে হবে জানেন অন্তর্যামী । 

বউটি বলে, দেখে এলাম সব,
পালাবার তো কোন উপায় নাই ।
ঘাঁটি আগলে বসে আছে ওরা,
অন্য কিছু ভাবতে হবে তাই । 

তবে একটা উপায় এখনও দেখি আছে,
যদি তাতে কিছুটা কাজ হয় ।
ব্রহ্মহত্যা হয়েছে অনেক হেথা,
বন্ধ এবার করবই তা নিশ্চয় । 

মনে রাখুন আমার ক’টা কথা,
বাঁচার রাস্তা আছে ওই একটাই ।
বলতে যদি পারেন ঠিক মতো,
অভিনয়টাও করতে পারা চাই । 

আমার নাম বামা, বাড়ির মেজ বউ,
হরিদাস আমার বাবার নাম ।
বাপের বাড়ি আমার কুসুমপুর ।
আপনারও বাস আমাদের সেই গ্রাম । 

আমরা হলাম দুটি মাত্র বোন,
ক্ষান্তমণি আমার দিদির নাম ।
তার শ্বশুরের নাম দুর্লভ দাস,
সামতাপুর, তেওটা বর্দ্ধমান । 

জাতে আমরা সবাই বারুই,
আমার বাবা এখনও আছে বেঁচে ।
মা মারা গেছেন আমার ছোটবেলায়,
জ্যাঠামশাই এখনও সাথেই আছে । 

বলবেন আপনি তাদের গুরুবংশ,
তখন যেন কাঁপে না এই গলা ।
সন্দেহ যেন না হয় কোন মতে,
তাহলে আপনার শেষ হবে ভব খেলা । 

ভয় পাবেন না গুরু ঠাকুরমশাই,
রান্না খাওয়া এবারে সেরে নিন ।
তারপরেতে শ্বশুরের কাছে গিয়ে,
আপনার এই পরিচয়টা দিন । 

খাওয়া দাওয়া সাঙ্গ করে আমি,
নিজের মনে বারেক ঝালিয়ে যাই ।
ভুলটি যদি কিছু বলে ফেলি,
সাঙ্গ হবে সাধের জীবনটাই । 

হটাত দেখি সামনে গৃহস্বামী,
দাঁড়ায় এসে দরজাখানি খুলে ।
ঠাকুরমশাই নিন পানটা খান,
গৃহস্বামী হেসে আমায় বলে । 

সামনে পেয়ে শুধাই আমি তারে,
একটা কথা আপনাকে আমি কই ।
আমার এক মন্ত্রশিষ্য আছে,
বাস যে তাহার এই সঞ্জয়পুরেতেই । 

হরিদাস নামটি তাহার,
ছোট মেয়ের নাম বামা ।
এখানে কোথাও হয়েছে তাহার বিয়ে,
আছে নাকি আপনার তা জানা । 

বলেছিল হেথায় আসার সময়,
ঘুরে আসতে তাদের বাড়ি থেকে ।
কাল সকালে সেথায় যাব আমি,
চেনে তাদের গ্রামের সর্বলোকে । 

আমার কথা শুনে গৃহস্বামী,
অবাক হয়ে আমার পানে চায় ।
সত্যি করে আপনি তাদের চেনেন,
দয়া করে বলুন তা সব আমায় । 

বামার কথা মনে স্মরণ করি,
দৃঢ় স্বরে বলি তাদের আবার ।
আমি হলেম তাদের গুরুবংশ,
মন্ত্রশিষ্য তারা আমার বাবার । 

বৃদ্ধ বলেন, দাদাঠাকুর, একটু বসুন,
ভিতর থেকে আসছি আমি ঘুরে ।
ভয় তখনও যায়নি পুরো আমার,
রেহাই তবে পাবো কি এরপরে । 

বেশ কিছুক্ষণ পরে গৃহস্বামী,
আমার কাছে আবার ফিরে আসে ।
পিছে আসে বাড়ির সব লোক,
বামাও দেখি আসে সবার শেষে । 

পরিচয় দেয় এক এক করে সবার,
সবাই এসে আমায় গড় করে ।
বামাও আসে ধীর পায়েতে শেষে,
চোখের জলে পা-টি আমার ভরে । 

আমারও চোখ অশ্রুজলে ভাসে,
দয়াময়ী তুমি আমার বামা ।
তুমি যদি থাকতে নাকো হেথা,
জীবন আমার যেত, তা তো জানা । 

সকাল হলে আমার যাবার কালে,
সপরিবার গৃহস্বামী আসে ।
পাঁচটি টাকা গুরুপ্রণামী দেয়,
শান্ত মুখে আশীর্বাদের শেষে ।।20150628

---------------------------------------------------------------------------------------
Contributed by: Aloke Chowdhury in WaaS / 28 June 2015

No comments: