------------------- সুবীর কুমার দাস সংকলন - সেপ্টেম্বর, ২০১৫ -------------------
।। জাতিস্মর ।।
গতকাল হঠাৎই আমাকে দেখা দিয়ে গেল আমার
গতজন্মের চেহারা
দেখে কি বলব তোমায় আমি তো বিস্ময়ে হাঁ—
মুখ দিয়ে বাক্য সরছে না
অপমানে, লজ্জায়, ঘৃণায়, নিজেকে দেখছি আর
মিশে যাচ্ছি মাটিতে, ঠিক
মাটিতেও নয়, তারও নীচে কবরখানায়
এক হাঁটু কাদাজলে
আমারই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে আমার
গতজন্মের চেহারা --
হাতে রক্ত, চোখে লম্পটের হাসি, মুখে বদ মদগন্ধ
আপাদমস্তক নীচ ...
তবু সরাসরি চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল
তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে :
নিজেকে খুব ভদ্র আর সৎ ভাবো তাই না ?
তোমার মতো ভালোমানুষ আর কেউ নেই, তাই তো ?
বলেই ছুঁড়ে দিল একতাড়া কাগজের গোছা, বলল
তবে এই নাও তোমার সম্পত্তির জাল দলিল
দেখো তোমার বাড়ীটাকে চিনতে পারো কী না
ভাইপোকে ফাঁসিয়েছিলে, নকল সই
মনে পড়ে ?
আর প্রথম স্ত্রীর গয়নাগুলো
এখনো যা লুকিয়ে রেখেছ ব্যাঙ্কের লকারে
মেয়ে জানে ?
আতঙ্কে শরীরের সমস্ত রক্ত নিমেষে সাদা,
ফ্যাকাশে ফতুর—
- আর কি কি জানে ও ?
ভয়ে, জন্ডিসের ঘোলা চোখে দেখি নিজের চেহারা
সত্যি মিথ্যের মায়াজালে এ জন্মের নিষ্ফল চেষ্টাগুলো
একে অপরকে জড়িয়ে ধরে
যেন জেনে গেছে কেন ব্যর্থ তারা
অবিশ্বাসের চোখে তাকায় আমার দিকে
আমিও লজ্জায়, ঘৃণায়, নিজেকে দেখি আর
মিশে যাই মাটিতে, ঠিক
মাটিতেও নয়, তারও নীচে
পাতালে, কবরখানায় … ||
০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫
---------------------------------------------------------------------------------
।। স্যালাইন ।।
বহুদিন এমন হয়েছে
বুকের একদম কাছে এসে বসেছে
আত্মহত্যা
সাপ-লুডো খেলার মতো খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে
দেখেছে আমাকে
আসলে দেখতে চেয়েছে আমার চালে
কি পড়ে
ছয় না পুট
এছাড়াও বহুদিন
গায়ের গন্ধ শুঁকে সাপের মতো লিকলিকে জিভ দিয়ে
চাটতে শুরু করেছে
বিষের বড়ি, আর
হাওড়া ব্রিজের ওপর
সাঁতার জানিনা বলে জলের সে কী ভীষণ
লাস্যময়ী হাসি …
বহুদিন স্বপ্নের মধ্যে সত্যি সত্যি
হারিয়ে ফেলেছি আমি নিজের বাড়ী
উঠোন বারান্দা সব ফাঁকা, কোনোখানে
কেউ নেই
দমবন্ধ একা শুয়ে আছি আমি আমারই কাছে
ছায়া-ছবির নীল শরীর …
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫
---------------------------------------------------------------------------------
।। পরিচয় ।।
শুধুমাত্র সম্ভাষণে থেকে গেল
ভাইও ঔর বহেনো
ভাগ বাঁটোয়ারা জানে এ শুধু কথার কথা
শুধুই অংশীদারি
সবটা সাজানো !
বাবার মৃত্যু সাক্ষী সম্পত্তির কিস্সায়
মার মৃত্যু জানে সে কেমন
সোনার কাহিনী
ভাইফোঁটার চন্দনে কেন নেই কাঁটামুক্ত মসৃণতা
রাখীবন্ধনের উৎসবে কেন শুধু ছেলে-খেলা গন্ধ
শুধুমাত্র সম্ভাষণে থেকে গেল
ভাইও ঔর বহেনো !
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫
---------------------------------------------------------------------------------
|| মিলেমিশে একাকার ||
কিছু কিছু কথার মধ্যে ভারি মিল, ভারি বন্ধুত্ব । একদম গলাগলি । পাশাপাশি দেখলেই বোঝা যায় সখ্যতা কাকে বলে । যেমন ‘সাহিত্যের সাত সতেরো’ । কিংবা ‘কবিতার কলা কৌশল’ । ভিতরে বিষয়ের গভীরতা থাক বা না থাক ওপরে মিলজুল আছে । ঠিক একইরকম কিছু কিছু নামের মধ্যেও দেখা যায় ভারি মিল । যেমন, সদাশিব সরকার, সিদ্ধেশ্বর সেন, উৎপল উপাধ্যায়, বরুণ বড়াল ইত্যাদি নানারকম । যেন সা-সা গা-গা মা-মা ....প্রায় গানের মতো, সুরেলা । তবে ইদানীং একটু বদলও হয়েছে । এখন পল্টু হয়ে গেছে পল্টন, কিংশুক শুধুই কিং .....রাজা ! যেন হঠাৎ করে বালি হয়ে গেছে বিলেত ! তবে পদবি তে সেই মান্ধাতার আমলই, চলছে যদিও জোড় লেগেছে । সেন-বরাট, বসু-মজুমদার, দত্ত-ধাড়া । ভাবখানা এই, আমি আমাকে ছাড়ছি না, তুমি এলে আসতে পারো ।
তবে মিলমিশ থাকলেই হলো, সেটাই সব । ইদানীং যার বড় অভাব । আগে মিল ছিল এখন নেই । জুট-মিল নেই, কটন-মিল নেই, স-মিল নেই । নেই নেই আর নেই । কিন্তু একটু খুঁজলেই দেখা যাবে আছে । কোথায় ? যে রামকৃষ্ণ পড়েছে সে জানে । আর যে জানেনা সে রামকৃষ্ণ না পড়া মানুষ । সে শোনেই নি ‘ওরে শুধু পদে পদে বিপদই দেখলি, আর পা-য় পা-য় উপায় দেখলি না’ !
মোদ্দা এই হলো কথা । কিন্তু শুনতে এত ভালো লাগে মনে ধরে কেন ? না পাশাপাশি ওদের ভারি মিল ভারি বন্ধুত্ব । পা আর পদ একই কি না ? নামে ডাকে কি আসে যায় !
— তাই বলে হরি আর হেরো এক না কি ? মিল থাকলেই হলো ?
জানতাম, আমি ঠিক জানতাম কেউ একটা গোল বাধাবেই । কিন্তু ভেবে দেখ হরিকে আমরা তো হারিয়েই বসে আছি । ধরবার চেষ্টা করো নি বলেই না ফাঁকা ফাঁকা, নেই নেই অনুভূতি । এক হিসাবে কথাটা তো ঠিক । তবে এ হারানো জয়-পরাজয়ের নয় । এ হারানোর অর্থ খোয়ানো । আর হরিকে হারিয়েছি বলেই না হেরে বসে আছি ।
— বাবা, এ যে একেবারে রামভক্ত রামছাগল ! হরিভক্ত হরিরাম !
বাহ্ বেশ চমৎকার বললে তো, কি করে বললে ভাই ? এ তো আমারই মিলমিশ সখ্যতার কথা বললে । তবে বিপরীত ভঙ্গিতে বললে । একবার উল্টে নাও পাল্টে যাবে । তবে তুমি যে উল্টে আছ এটাই আগে বুঝতে হবে । না হলেই আবার নেতি নেতি, ন্যাতানো ।
— দুর মশাই সোজা-সাপ্টা বলুন তো কি বলতে চাইছেন ?
এত সোজা করে বলছি তাও বুঝতে পারছ না? আমি মিলমিশ সখ্যতার কথা বলছি ।
— কিন্তু আমরা আপনার কথা শুনব কেন ? আপনি কে ?
সে আমার নাম শুনলেই বুঝতে পারবে ।
— কি আপনার নাম ?
সে বলছি, তবে এ নাম কে রেখেছে বলতে পারব না ।
— সে আমরা বুঝব, আপনি বলুন ।
আমার ফার্স্ট নেম : রমণী, মিডল নেম : রমণ, আর লাস্ট নেম মানে টাইটেল : কর । এবার বুঝলে তো মিলমিশ কত সুখের কত মজার !
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫
---------------------------------------------------------------------------------
|| কি নিয়ে এসেছ ||
- বলো, কি নিয়ে এসেছ ?
- খালি হাতে প্রভু ।
- ভুল ।
- বলো, কি নিয়ে যাবে ?
জীবনে এত বার ফেল করেছি এতরকম কাজ করতে গিয়ে যে আর ফেল করতে ইচ্ছে করে না । সারাজীবন সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে শুনে এলুম, খালি হাতে এসেছ খালি হাতে যাবে, সঙ্গে কিচ্ছুটি না । আর যেই প্রভুর প্রশ্নের উত্তরে বললুম, সঙ্গে সঙ্গে ভুল ! এরপর আর উত্তর দিতে ইচ্ছে করে ?
- কি হলো চুপ করে রইলে যে বড় ।
- না প্রভু ...
- কি না ? বলো ...
- খালি হাতে প্রভু ।
- ফের ভুল ।
- এ্যাঁ ....
এ্যাঁ নয়, হ্যাঁ । যা শিখেছ সব ভুল । আর কি হবে, বাবাগুলোই কিছু জানে না তো ছেলেগুলো শিখবে কোত্থেকে ? খালি হাতে এসেছে ! আদিখ্যেতা ! খালি হাতে মানে ? ও তো তোমার চোখের দেখা । হাত খালি । আমি জিজ্ঞেস করলুম কি নিয়ে এসেছ ? এখন তোমার বয়স পঞ্চাশ । এতখানি জীবনে কি বলতে চাও তুমি যা যা পেয়েছ সব তোমার চেষ্টায় ? বিয়ের সময় দিদিশাশুড়ি টুপ করে গলায় একটা দু ভরির সোনার চেন দিয়ে আশীর্বাদ করল, সেটা ? শ্বশুরমশাই ওমেগা ঘড়ি । অমন পরীর মতো মেয়ের বাবা হ’লে । মেয়ের রূপটা কি তোমার তৈরি ? সকলের হয় ? যে বাড়িতে আছো তার একটা কিছু ... ইট কাঠ থেকে শুরু করে সিন্দুকের যা কিছু ভোগ করছ বাবা সে কি তোমার নিজের রোজগারের পয়সায় ? আবার বলে কি না খালি হাতে ! শুধু বয়স হয়েছে সংখ্যায়, বুদ্ধিতে বয়স সেই ফেলটুস মেরে বসে আছে ।
- মাথায় ঢুকল কিছু ?
- আজ্ঞে ?
- বলছি বুঝতে পারলে কিছু ?
- হ্যাঁ প্রভু ।
- তাহলে এবার বলো কি নিয়ে যাবে …
মাথার মধ্যে সেই একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল … খালি হাতে , খালি হাতে । তারপর বলি, আর একঘর লোকের সামনে আবার ফেল । এ লজ্জা কি আর থামবে না ? কি পাপ করেছিলাম কে জানে ! সব কত কম বয়সী ছেলে মেয়ের সামনে আর কত অপদস্থ হবো রে বাবা । প্রথমে তো বলেইছিলুম, খালি হাতে , তো সেটা ভুল যখন কি বলি এবার ?
ভাবো ভাবো, তোমরা সবাই ভাবো । আমি শুধু ওকে প্রশ্নটা করেছি ভেবো না, আমি জানি তোমাদের সকলের ঐ একই উত্তর । ও খামোখা লজ্জা পাচ্ছে । তোর এত লজ্জা পাবার কিছু নেই । ওরে, ওরা সবাই তোর মতো নাবালক নাবালিকা । বয়সগুলোই যা শুধু ভুঁড়ির মতো ফুলে উঠেছে । বুদ্ধিতে সবাই বেতো । নড়েও না চড়েও না । একটু নড়তে চড়তে গেলেই উঃ আঃ । আর বুদ্ধির কি বা দোষ , খেতে পায় তো শুধু খবর আর খবরের কাগজ ।
ঘরের মধ্যে একদম নিরামিষ নিস্তব্ধতা । যেন খুবই একটা বেশ মার্জিত সভ্য শ্রাদ্ধবাসর । কেউ কোনও কথা বলছে না । একেবারে ঠাণ্ডা দইয়ের মতো জমাট মেরে গেছে । একটা ঘোলমউনি দিয়ে ঘাঁটিয়ে না দিলে কিচ্ছুটি হবার নয় । তো ঢালো জল । তাই একটু সাহসে ভর করে বললুম, বুঝতেই তো পারছেন প্রভু যা বলব তা ভুল, তার চেয়ে ঢের ভালো আপনিই বলুন । আমরা শুনি ।
প্রভু একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসলেন ।
- কি চালাক দেখেছ ! একেবারে বিচ্ছু । ওর হার স্বীকার করে নিলেই কি খেলা শেষ ? খুব তো হিন্দি সিনেমা দেখিস, ভিলেনকে হারিয়ে যখন হিরো বলে - চুন চুন কে বদলা লুঙ্গা ....খুব মজা লাগে । হেব্বি দিয়েছে ! এবার ? কেমন লাগছে ?
যেমনই লাগুক, এরকম রসিক গুরুদেব পেলে আমি রোজ দুবার কেন দু'শো বার হারতে প্রস্তুত । কি সুন্দর বলে বলো ? কোথায় দিব্যজ্ঞান আর কোথায় হিন্দি সিনেমা ! সব একদম ককটেল মকটেল করে ছেড়ে দিলে গো । আমার টেল-এ একটু টান পড়ল বটে, তা পড়ুক । কিছু একটা ভালো জানা তো হলো ।
শোনো তবে বলি । খালি পায়ে খালি হাতে কেউ যায় না । কেউ যাবেও না । ঐ যে আসার সময় খালি হাতে এলে কিন্তু সোনার হারটা পেলে । ঠিক তেমনই ঐ খালি পায়ে যাবে কিন্তু জেনে রাখো তোমার জন্য উল্টোডাঙার বস্তিও রেডি আবার আমেরিকার উঁচু নব্বই তলার ফ্ল্যাটও রেডি । এছাড়াও মাঝেমধ্যে ছোটো বড় মাঝারি … হাতে অনেককিছু আছে । সবই সাজানো । কিন্তু কোথায় যাবে কে ঠিক করবে ? না তুমি । এ কি প্রচণ্ড স্বাধীনতা একবার ভাবো । যদি বুঝতে পারো তো সেইমতো চলো । আর একেই বলে, বোঝো মন যে জান সন্ধান । সন্ধান করো, সন্ধান । কোথায় যেতে চাও তুমি । ঠিকানা ঠিকই দেখতে পাবে ।
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫
--------------------------------------------------------------------------------------------
Contributed by: Subir Kumar Das in WaaS / September 2015
No comments:
Post a Comment