।। ফন্দী ।।
এবার বেজায় গরম পড়েছে দেশের সর্বত্র । টিভি খুললেই পরদায় ভেসে উঠছে খরা কবলিত এলাকাগুলির ফুটিফাটা চাষের জমি, দুপুরের শুনশান পথঘাট । গছের পাতাটিও নড়ছে না বাতাসের অভাবে । মানুষ বসে বসে ধুকছে ঘরে বাইরে সর্বত্র । দিন রাতের কোনও বালাই নেই । আমিও সারারাত ঘুমোতে পারছি না গরমে কাহিল হয়ে । মাথার ওপর ফ্যান, পাশের দিকে স্ট্যান্ড ফ্যান সাইসাই করে ঘুরছে তবুও নিস্তার পাচ্ছি না গরমের হাত থেকে । ঘামে সেদ্ধ হতে হতেই কেটে যাচ্ছে গোটা রাতটা । ভোরে বিছানা ছেড়ে নামার সময় মনে হলো যেন সেই ছেলেবেলাকার বিছানায় শুয়েছিলাম এতক্ষণ । যেন হিসি করে তোষক ভিজিয়েছি স্বপ্নে দেখা বাঘের তাড়া খেয়ে! তারপরই ভয়ে কাঁটা হয়ে গেলাম । এই বুঝি মা এসে বকুনি দিয়ে বলবেন, আজও ভয় পেয়েছিস বাঘের তাড়া খেয়ে ? আর কবে বড় হবি ?
মায়ের এই বকুনি খেয়ে খেয়ে আজ এতোটাই বড় হয়ে গেছি যে আমাদের বিশাল সংসারটাই কবে যেন ছোট হয়ে গেছে! মা হয়তো সেই অভিমানেই আমাদের ছেড়ে একদিন চলেও গেলেন অন্য লোকে ! সাথে নিয়ে গেলেন বাবাকে । সেই থেকে আমাদের সংসারটা আরও ছোট হয়ে গেল । আমি, আমার স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান । এই নিয়েই এখনকার এই সংসার ।
ব্যাপারটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই যে ঘটছে তেমনটা মোটেও নয় । বন্ধুদের সাথে দেখা হলেই সব ছেড়ে শুধুই গরমে কাহিল হয়ে পড়ার গল্প হয়ে চলেছে । আর একবার শুরু হলে থামার কোনও লক্ষণও দেখা যায় না! সকলেই বেজায় কাহিল যে হয়ে আছে । একমাত্র অফিসে গেলে খানিকটা নিস্তার পাই গরমের হাত থেকে । বাতানুকূল পরিবেশে কেতে যায় দিনের বেশ কিছুটা সময় । কিন্তু তারপর আবার যে সেই গরমের হাতেই সপে দিতে হয় নিজেকে ।
বাড়িতে ফিরে আসলেই প্রাকৃতিক গরমের সাথে যুক্ত হয় গিন্নির রোষানলের উত্তাপ । দু’টোকে একসাথে মানিয়ে চলতে চলতেই রাত কাবার হয়ে যায় । গিন্নীকে দোষ দিয়েও লাভ নেই । আমি তবুও বেশ কিছুটা সময় অফিসে থেকে নিস্তার পাই গরমের হাত থেকে । অথচ তাঁর বেলায় তো তেমনটা হবার উপায় নেই । শুধু তাই? তাঁর বেলায় গোঁদের ওপর বিষ ফোড়ার মত এসে জোটে রান্নাঘরের উনুনের তাপ, গরম ভাত-তরকারীর ভাপ । মাঝেমাঝেই ভাবি কী করে এখনো টিকে আছেন এতকিছু গরমের সাথে লড়াই করে!
ভোরের দিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম । তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা ঘণ্টা খানেক পরই কেটে গেল কাঁচের জানালার পাশে এসে জুটে পাখিদের ক্যাঁচরম্যাচর করায় । বিছানা ছেড়ে নামতে যেতেই আজও মনে হলো, যেন সেই ছেলেবেলাকার বিছানায় শুয়েছিলাম এতক্ষণ । যেন হিসি করে তোষক ভিজিয়ে দিয়েছি স্বপ্নে দেখা বাঘের তাড়া খেয়ে! আজও আগের মতো নিজের অজান্তেই ভয়ে কাঁটা হয়ে গেলাম । এই বুঝি মা এসে বকুনি দিয়ে বলবেন, আজও ভয় পেয়েছিস বাঘের তাড়া খেয়ে ? আর কবে বড় হবি ?
ভাবনায় ছেদ পড়লো গিন্নীর বাক্যবাণে বিদ্ধ হতে, আর কতক্ষণ শুয়ে থাকবে? গরম-ঠাণ্ডা বলে তো নিস্তার পাবো না কোনও কালেই । সেই আমাকেই গুষ্টির পিণ্ডি যে রাঁধতে হবে গরমে ভাজা ভাজা হয়ে । তাড়াতাড়ি গিয়ে যাইহোক কিছু বাজার করে এনে উদ্ধার করো দিকি ।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে হলো তাঁর বাক্যবাণের গুঁতোয় । হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখি, তিনি চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন । আমাকে দেখে চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর ঠক্ করে নামিয়ে দিয়েই চলে গেলেন বাজারের থলে আনতে । যেন ইশারায় বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন চা-টুকু গিলে বাজারের পথ ধরো তো বাপু ।
চা খেয়ে বাজারের পথ ধরলাম সাইকেলে চেপে । উফ্ এই সাতসকালেই রাস্তায় যে গরম হাওয়া বইছে! বাজারে যাবার পথেই পড়ে খুব বড় একটা দীঘি, নাম তালপুকুর । পুকুরটা জলে টলটল করছে আপাদমস্তক । জলের বুক থেকে উঠে আসছে শীতল হাওয়া । সাইকেল থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম ঠাণ্ডা হাওয়ায় গা ভিজিয়ে নিতে । আহঃ কি আরাম । রাতটা যদি এখনেই কাটিয়ে দিতে পারতাম তাহলে তোফা ঘুম দেওয়া যেতো ।
এসব ভাবতে ভাবতে এদিক সেদিক তাকাতেই চোখে পড়লো ব্যাপারটা । পুকুরের পাড়েই বাঁধানো একটা ধাপে পাড়ার মস্তান কুকুরটা ঘুমিয়ে আছে চার পা ছড়িয়ে ! দেখেই চমকে উঠলাম, আরিব্বাস ! কুকুরটা তো খুব সুন্দর একটা জায়গা বেছে নিয়েছে রাত কাটানোর জন্যে! অথচ আমি কিনা ঘরের গুমোট গরমে পাখা চালিয়ে ইলেকট্রিকের বিল ভারী করছি !
জল থেকে উঠে আসা ঠাণ্ডা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে আবার সাইকেলে চাপলাম । প্যাডেলে চাপ দিয়ে বাজারের পথ ধরে এগোতে এগোতেই মাথায় এলো ফন্দীটা । রাত্রে এসে কুকুরটাকে ভাগিয়ে দিয়ে জায়গাটা দখল করে নিলে কেমন হয় ? পরক্ষণেই একটা নিদারুণ ভয় এসে চেপে বসলো বুকের ভেতর । তখন আমাকে দেখে কেউ যদি চোর ছ্যাঁচোর বা তেমন কিছু ভবে বসে তখন কি করবো ?
--------------------------------------------------------------------------------------------------------
Contributed by: Sudhansu Chakraborty in WaaS / 15 September 2015
No comments:
Post a Comment