--------------------- সুধাংশু চক্রবর্তী সংকলন – জুলাই, ২০১৫ ---------------------
।। ফিলি দিত্তি কিন্তু ।।
প্রায়শই দেখি, সামনে বাড়ির বছর দেড়েকের আধফুটিয়া কচি ছেলেটিকে তার বাবা পাজকোলা করে তুলে এনে বাড়ির সামনের বড় নালাটার ওপর ঝুঁকে পড়ে ছেলেকে বলতে থাকে, দেবো নালার মধ্যে ফেলে ?
কচি ছেলেটি ভয় পেয়ে চিৎকার জুড়ে দেয় । আধো আধো গলায় বলে, আল দুত্তুমি কলবো না ।
আজ কচি ছেলেটির মায়ের চড়া গলার ধমক শুনে জানালার সামনে এসে দেখলাম, মা বেধড়ক বকাঝকা করছে ছেলেটিকে । নিশ্চয়ই কিছু একটা দুষ্টুমি করেছে ।
যথারীতি আবার সেই আধোআধো গলার বুলি কানে ভেসে এলো, আল দুত্তুমি কলবো না ।
মা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের কাজে মন দিলো ।
খানিক পরই দেখি কচি ছেলেটি মায়ের একপাটি চপ্পল হাতে নিয়ে ছুটে এলো নালাটার কাছে । তারপর চপ্পলটা নালার ওপর তুলে ধরে মাকে ডেকে আধো আধো গলায় বলতে থাকলো, ও মা, তুতিতা ফিলি দিই । এই দ্যাকো, ফিলি দিত্তি কিন্তু ।
হাসতে হাসতেই দেখলাম, ছেলেটির মা তেড়ে আসছে ছেলেটির দিকে ।
০৪ জুলাই ২০১৫
-------------------------------------------------------------------------------
।। সাতমহলা বাড়ি ।।
ভেবেছিলাম গড়বো এক সাতমহলা বাড়ি
তেপান্তরের মাঠের পাশে
তাল সুপারিরই সারি
থাকবে সেথায় । দখিণা হাওয়ায়
প্রাণ জুড়োয়ে, পড়বে তোমার চরণখানি
মনের আঙ্গিনায়,
বুকের কাছে ঝুলিয়ে বেণী
আমার কাছে আসবে ধীর পায়ে
সাতমহলা বাড়িটির ওই সুখের ঠিকানায় ।
ভেবেছিলাম অনেক কিছুই
যেমনটি মন চায়
হলো না তাই যত্ন করে রাখি তুলে
স্মৃতিরই কোঠায় ।
সাতমহলা বাড়ি আজ গড়েছি বুকের মাঝে
প্রেমের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখি
সকাল থেকে সাঁঝে
ভয়ের কাঁটায় বিঁধে আছি
পথ হারিয়ে যাও যদি তুমি ফিরে ?
আর না আসো যদি ? এসব ভয়ের সাথে
এখন খেলছি কানামাছি ।
০৪ জুলাই ২০১৫
-------------------------------------------------------------------------
।। বৃষ্টি সামান্য থেমেছে ।।
বৃষ্টি সামান্য থেমেছে । আমিও গুটিগুটি পায়ে
ছাতা মাথায় দিয়ে এগিয়ে যাই ।
বাতাসে লেগে থাকা জলের কণাগুলি
স্যাঁতস্যাঁতে করে দেয় মনের ভেতরে জমে
থাকা সুন্দরীদের মুখগুলি ।
তবুও থামে না বৃষ্টি বারেকের তরে
আমিও না, কেউ না কেউ ঠিক এসে উঁকি
মেরে যে যায় মনের দুয়ারে ।
কদমের গাছে গাছে ফুলের সুবাস
ভেসে আছে, ফুলেরাও বুঝি ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস
রাধিকার দেখা নেই বলে ।
বৃষ্টি কি একবারও থেমেছে তা’বলে ?
অভিজ্ঞতায় নুয়ে পড়া প্রাচীন বটের তলায়
বাঁধানো চাতালের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যাই
যদি কোনও রাধিকার সন্ধান পাই
সেখানে সেই আশায় ।
সন্ধ্যে গড়িয়ে চলে নিজের নিয়মে
পূবের মলিন আকাশখানি কালো করে মিহিজামে
রাত নামে অতি দ্রুত পায়ে
আমিও চাতালে বসে অপেক্ষায় থাকি
কোনও এক রাধিকার আশায় ।
১০ জুলাই ২০১৫
--------------------------------------------------------------------
।। দামালের দল ।।
বৃষ্টির জলে ভিজে হয়ে ভেজা কাক
ঘরে ফিরে আসে ঐ শিশুদের ঝাঁক ।
তারমানে স্কুলে আজ হয়নি কো পড়া
ভিজেছে বইখাতা, ভিজেছে ধড়াচূড়া ।
বন্ধ ছাতা বগলে ঝোলে, আছে বর্ষাতি
তারও হয়েছে দেখি ছাতারই গতি !
দিঘীর বুকে নাচে যতেক কুমুদিনী
ঘরমুখো শিশুগুলি কাঁপায় মেদিনী ।
ছপ্-ছপ্ শব্দ ওঠে রাস্তাডোবা জলে
ভয় পেয়ে ব্যাঙকুল হাঁক-ডাক ভোলে ।
সোনাব্যাঙ লম্বা ঠ্যাঙে এক লাফ দিয়ে
পালিয়ে বাঁচলো দেখি প্রাণ হাতে নিয়ে ।
ওই যে আসছে দস্যি দামালের দল
মানে না কো বৃষ্টি তারা, বড়ই চঞ্চল ।
গেছোব্যাঙ লাফ দিয়ে চড়ে বসে গাছে
কচিগুলো ঢিল ছুঁড়ে মারে যদি পাছে ।
মক-মক করছিলো কুনো ব্যাঙ দুটি
ভয় এসে চেপে ধরে তাহাদের টুঁটি ।
দুপুর পালায় আজ অতি দ্রুত পায়ে
সন্ধ্যে নামিছে ধীরে শিশুদের গাঁয়ে ।
১০ জুলাই ২০১৫
------------------------------------------------------------------------------
।। শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রার কিছু অমৃতকথা ।।
(১)
ব্রহ্মপুরাণে বলা হয়েছে –
‘আষাঢ়ষ্য সিতে পক্ষে দ্বিতীয়া পুষ্যসংযুতা । / তস্যাং রথে সমারোপ্য রামং মাং ভদ্রয়া সহ । ।
যাত্রোৎসবং প্রকুর্ব্বীত প্রীণয়েচ্চ দ্বিজান্ বহূন্ । / ঋক্ষাভাবে তিথৌ কার্য্যা সদা সা প্রীতয়ে মম । ।
আষাঢ়ের শুক্লপক্ষীয় পূষ্যনক্ষত্রযুক্তা দ্বিতীয়াতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা হয়ে থাকে । এজন্যে সেই দিনে যাত্রা, মহোৎসব ও বহু ব্রাহ্মণ ভোজন করাতে হয় । যদি দ্বিতীয়া পূষ্যানক্ষত্রযুক্তা না হয়, তবুও তিথিমাহাত্ম্য জন্যে সেসবই করতে হবে ।
“নীলাচলনিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে । / বলভদ্রসুভদ্রাভ্যাং জগন্নাথায় তে নমঃ । ।”
(২)
পুরাণ প্রসিদ্ধ যে কয়েকটি প্রাচীন ধর্ম ও সংস্কৃতির পীঠ আজও বর্তমান তার মধ্যে পুরী অন্যতম । হিন্দু পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রে ভারতবর্ষের চারটি প্রসিদ্ধ ধর্মের বর্ণনা রয়েছে । এর মধ্যে পুরী অন্যতম । পুরীর নাথ জগন্নাথ, দক্ষিণভারতে রামনাথ, পশ্চিম ভারতের গুজরাতে দ্বারকানাথ এবং উত্তরভারতে বদরিনাথ । কথিত আছে, প্রভু জগন্নাথ বদরিনাথে স্নান করেন, দ্বারকায় বেশভূষা পরিধান করেন, পুরীতে অন্ন ভোজন করেন এবং রামেশ্বর ধামে শয়ন করেন । সেই কারণে পুরী ধাম জগন্নাথদেবের ভোজন ধাম রূপেও প্রসিদ্ধ ।
(৩)
ডঃ হরেকৃষ্ণ মহতাব তাঁর ‘হিস্ট্রি অফ ওড়িশা’ বইটিতে লিখেছেন – “সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে উড়িষ্যার শবর সম্প্রদায়ের লোকজন বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলো । পুরীতে একটি বৌদ্ধ স্তুপ ও গড়ে ওঠে । সেখানে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ – বৌদ্ধধর্মের এই ত্রি-রত্নের পুজো শুরু হয় । এই ত্রিরত্নই হলেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা । জগন্নাথ হলেন বুদ্ধদেব, ধর্ম ও সংঘের প্রতীক যথাক্রমে সুভদ্রা ও বলভদ্র । অর্থাৎ প্রাচীনকাল থেকেই জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার দারুমুর্তির পুজো প্রচলিত ।” এই তিন বিগ্রহের দারুমুর্তিরূপ উড়িষ্যার গোঁড়া ব্রাহ্মণেরাও মেনে নেন । কারণ তাঁরা বিশ্বাস করতেন, জগন্নাথদেবের আত্মা বা ব্রহ্ম একটি অমূল্য শালগ্রামশিলা রূপে তাঁর দারুনির্মিত মূর্তির মধ্যেই লুকোনো রয়েছে । অন্য দেবদেবীর মূর্তির মতো জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রার মূর্তি সম্পূর্নরূপে মনুষ্যাকৃতি নন । এই তিন মূর্তির কান, হাতের পাতা, পা ঠোঁট, ভ্রু নেই । ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীনকালে উড়িষ্যার আদিবাসী শবররা একটি কাঠ স্থাপন করে সেটিকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করতো । সিঁদুর, কাজল ইত্যাদি পদার্থে তাঁর চোখ, মুখ আঁকত । এইভাবে শবর জাতির এক দেবতার পুজো ক্রমশ বেড়ে আজকের জগন্নাথ উপাসনায় পরিণত হয়েছে । শবরদের দেবতা ‘জগন্ত’ থেকেই কালক্রমে ‘জগন্নাথ’ নামটি এসেছে ।
(৪)
মাদলাপাঁজি হলো তালপাতার বিভিন্ন পুঁথি যাতে উড়িষ্যার রাজা-রাজড়া ও পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরের ইতিহাস লেখা রয়েছে । মাদল হলো এক ধরণের ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র । তালপাতার প্রত্যেকটি পাতা একটু লম্বাটে ধরনের । সেগুলো গোল করে এমনভাবে একসঙ্গে বাঁধা হতো যে তা অনেকটা ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র মাদলের আকৃতি পেতো । এরকম এক একটি মাদলাকৃতি তালপাতার গুচ্ছ নিয়েই বিভিন্ন ধরনের পাঁজি । মাদলের মতো দেখতে বলেই একে মাদলাপাঁজি বলে । অনেকের মতে তালপাতার পুঁথিগুলো মাদলের ফাঁকা খোলের ভেতরে সযত্নে রেখে দেওয়া হতো যাতে পুঁথিগুলোর কোনও ক্ষতি না হয় । এই জন্যেই এর নাম নাকি মাদলা পাঁজি । মাদলা পাঁজির রাজভোগের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, যযাতি কেশরীর রাজত্বের প্রায় ১৪৬ বছর আগে ‘রক্তবাহু’ নামে প্রবল পরাক্রমশীল এক মুসলমান বহিঃশত্রুর আক্রমণে ওড্রদেশ অর্থাৎ উড়িষ্যার অনেক অঞ্চলেই বিধ্বস্ত হয় । ধ্বংস হয় পুরী ।
(৫)
বিগ্রহ নির্মাণ পদ্ধতি অনুযায়ী জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রার অঙ্গগুলিকে চার-পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয় – শ্রীমুখ, হিয়া (হৃদয়), পারিধাপানা (কোমর) ও শ্রীচরণ । তবে সুভদ্রার হাত বা পা নেই । বিগ্রহগুলির উচ্চতা হলো – জগন্নাথদেব ১৬ ফুট, বলভদ্র ১৪ ফুট ও সুভদ্রা ১২ ফুট । ‘শুদ্ধ আষাঢ়’-এর অমাবস্যার দিন কয়েকজন প্রবীণ পুরোহিত চোখ বেঁধে ‘ব্রহ্ম’ পরিবর্তনের কাজ সুসম্পন্ন করেন । ‘ব্রহ্ম’ পরিবর্তনের জন্যে প্রতিটি শ্রীঅঙ্গে একটি ছোট গর্ত থাকে । কথিত আছে, ‘ব্রহ্ম’ পরিবর্তনের পবিত্রতম কাজটি করার পর সেই প্রবীণ পুরোহিতেরা নাকি আর বেশীদিন বাঁচেন না ।
(৬)
মানুষের দেহ যেমন শিরা-উপশিরা, রক্ত, মাংস, অস্থিমজ্জা, ত্বক ইত্যাদি সহযোগে তৈরি হয় কৈলি বৈকুণ্ঠে বিগ্রহগুলির শ্রীঅঙ্গ নির্মাণ শেষ হলে সেই শ্রীঅঙ্গেও তেমন রূপ দেওয়া হয় । শ্রীঅঙ্গগুলিকে সিল্কের বস্ত্রের টুকরো ও পাটের দড়ি দিয়ে খুব যত্ন করে প্যাঁচানো হয় । তাতে লাক্ষা ও চন্দনের মোটা প্রলেপ দেওয়া হয় । চন্দনের সঙ্গে কর্পূর, কেশর, কস্তূরী ও নানা সুগন্ধি মেশানো হয় । কাপড় ও পাটের দড়ির আস্তরণের ভেতর নিমকাঠের টুকরো ঢুকিয়ে দেওয়া হয় । এই পাঠের দড়ি হলো শ্রীঅঙ্গের শিরা-উপশিরার প্রতীক । সিল্কের বস্ত্র হলো তার ত্বক । চন্দনের প্রলেপ হলো তার মজ্জা আর নিমকাঠের টুকরোগুলি হলো অস্থি ।
(৭)
রথযাত্রার সময় জগন্নাথদেব যে সাতদিন মাসির বাড়ি (পাতানো মাসি গুণ্ডিচা দেবী) থাকেন সেই ক’দিন পোড়া পিঠে খান । এই পোড়া পিঠে বানানো হয় আড়াই মণ ঘি, আড়াই মণ চিনি, আড়াই মণ ছানা ও আড়াই মণ চালের গুঁড়ো দিয়ে । এই সব দিয়ে চাকার মতো বিরাট তিনটি পিঠে তৈরি করা হয় । অন্যান্য ভোগের সঙ্গে এই পিঠেগুলিও নিবেদন করা হয় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে ।
(৮)
জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ও চৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে একটি কিংবদন্তিও আছে । বলগুণ্ডিতে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর বাঙালি ভক্তরা আবার শুরু করলেন রথটানা । কিন্তু রথ আর এগোয় না । রাজা প্রতাপরুদ্রের নির্দেশে কয়েকজন স্বাস্থ্যবান পালোয়ান রথের রশি ধরে টান দিলেও রথ এতটুকুও নড়ল না । হাতি দিয়ে টানার ব্যবস্থা হলো । রথ তবুও নড়ে না । মহাপ্রভু চৈতন্যদেব ভক্তদের সাথে সেখানে এসে দেখলেন, মাহুতদের অঙ্কুশের আঘাতে হাতিগুলি চিৎকার করতে করতে রথ টানার চেষ্টা করছে অথচ রথ যে এতটুকুও নড়ে না ! লোকজন হাহাকার করছে । মহাপ্রভু এগিয়ে গিয়ে হাতিদের সরিয়ে দিয়ে নিজ ভক্তদের বললেন রশি ধরে টানতে । তিনি নিজে রথের পেছনে গিয়ে ঠেলতে লাগলেন মাথা দিয়ে । অবাক কাণ্ড, রথ আবার চলতে লাগলো হড়হড় করে ! চৈতন্যপ্রতাপ দেখে লোক ধন্য ধন্য করতে লাগলো ।
(৯)
মানুষের যেমন জন্ম-মৃত্যু আছে জগন্নাথদেবও তাঁর পুরনো দেহ ছেড়ে নতুন দেহ ধারণ করেন । সেই কারণেই পুরীতে এই নবকলেবর উৎসব অনুষ্ঠিত হয় । তিন বিগ্রহ তাঁদের পুরনো দেহ ত্যাগ করলে কৈলি বৈকুণ্ঠেই ৯ হাত গভীর ও ৬ হাত ব্যাসার্ধের একটি গর্তে রেশমের বস্ত্র ও তুলোর বালিশে তিন বিগ্রহের পুরনো শ্রীঅঙ্গগুলিকে শুইয়ে সমাধি দেওয়া হয় । তাঁদের সাথে সুদর্শনকেও সমাধি দেওয়া হয় । শিয়ালি লতাগাছে ছাওয়া দেবতার এই সমাধিস্থলে প্রতিদিন শ্রীমৎভাগবৎ গীতা পাঠ করা হয় । আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যত বৃষ্টিই হোক না কেন জগন্নাথদেবের এই সমাধিস্থলে কখনো জল দাঁড়ায় না !
(১০)
পরমব্রহ্ম রূপী জগন্নাথকে যেভাবে কল্পনা করা যায় সেভাবেই ভক্তের চোখের সামনে ধরা দেন বলেই সকলের বিশ্বাস । তাঁর বেশবাস ও চেহারা সামান্য অদলবদল করে যে-কোনও রূপ দেওয়া যেতে পারে । যেমন স্নানযাত্রার সময় জগন্নাথকে গনেশরূপে কল্পনা করা হয় । তাঁর মুখমণ্ডলে হাতির শুঁড়ের মতো লাগানো হয় । জগন্নাথ বোধহয় একরকম কোনও বাঁধাধরা রূপে পরিচিত হতে চান না । একদল গবেষকের মতে – দেশে একসময় কুষ্ঠরোগের দারুণ প্রকোপ ছিল । রোগীরা নিরাময়ের জন্যে পূরীর সমুদ্রে স্নান করতে আসতেন । এই রোগের অন্য কোনও চিকিৎসাও ছিল না তখন । কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত অনেকেরই হাত-পা ক্ষয়ে যেতো । লোকে এদের ঘৃণার চোখে দেখত । তাই জগন্নাথদেব অপূর্ণ হস্তপদ রূপ নিয়ে সকলকে বলতে চান যে, এঁরাও মানুষ এবং ঈশ্বরের সন্তান । অপূর্ণ হস্তে জগন্নাথদেব ও বলভদ্রের আলিঙ্গনভাব – যেন ভক্তদের আলিঙ্গন করতে চান । ভগবান ও ভক্তের মধ্যে যাতে কোনও প্রাচীর না থাকে তার জন্যেই এই অপূর্ণ হস্তরূপী জগন্নাথের হাতে কোনও অস্ত্র থাকে না । কেউ কেউ মনে করেন, কলিযুগে ভগবানের হয়ে তাঁর ভক্তরাই সব কাজ করবে । তাই ঈশ্বরের হাত-পায়ের কোনও প্রয়োজন নেই ।
১৮ জুলাই ২০১৫
----------------------------------------------------------------------------
।। তৈরি হয়ে থাকা ।।
কলিং বেলের আওয়াজ শুনে ফ্ল্যাটবাড়ির দরজা খুলতেই কুন্ডুজায়া ঘরের ভেতরে গলা বাড়িয়ে দিয়ে হেসে বললেন, কি গো মহুয়া, তোমার মুখটা তো দেখলাম না সেই সকাল থেকে ? খুব ব্যস্ত বুঝি ?
মহুয়া মিষ্টি হেসে জবাব দিলেন, আর বলবেন না দিদি । আপনাদের সাথে দুটো কথা বলবো সে উপায় কী আছে ? কর্তা বাজার থেকে একগাদা ছোট ছোট মাছ নিয়ে এলেন ঘণ্টা খানেক আগে । সেগুলোর পেছনে লেগে থেকেই তো সময়গুলো খরচ হয়ে গেল হু-হু করে । সবে খাওয়াদাওয়া শেষ করে গল্পের বই নিয়ে বসতে যাচ্ছিলাম । বেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুললাম ছুটে এসে ।
কুণ্ডুজায়া শুনে মাথায় হাত দিয়ে অবাক গলায় বললেন, জানি মেয়েদের কপালে রান্নাবান্না করার কথাটা লেখা হয়ে যায় জন্মাবার পরমুহূর্ত থেকেই । তা’বলে দুটো দিন হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করবেন না ? সবে তো গতকাল রাত্রে এসেছেন!
মহুয়া কিছু বলার আগেই লাগোয়া ফ্ল্যাটের দরজার ফাঁক দিয়ে রায়চৌধুরী গিন্নীর মাথার সাথে গলাটাও বেরিয়ে এলো ঘরের বাইরে । তিনি একমুখ হাসি ঝরিয়ে যোগ দিলেন এদের সাথে, আরে বাহ্, এখানে তো জমিয়ে আড্ডা বসে গেছে! অথচ আমি কিনা বাদ থেকে গেলাম এই সুখ থেকে । ওটি হবে না । দাঁড়ান এক্ষুনি একটা চেয়ার নিয়ে আসছি ভেতর থেকে ।
রায়চৌধুরী গিন্নী কথা কয়টা বলেই মিলিয়ে গেলেন ঘরের ভেতর । যাবার আগে দরজাটা বুজিয়ে দিয়ে গেলেন এদের মুখের সামনেই । এটাই ফ্ল্যাটবাড়ির একটি অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে । কেউ ভুল করেও ঘরের দরজা খুলে রাখেন না । কে কখন হুট্ করে ভেতরে ঢুকে পড়বে তার ঠিক কি ? তারপর কি কি ঘটবে বা ঘটতে পারে সেসব কথা যে পরদিনই খবরের কাগজে ছেপে বেরোবে ছাপার অক্ষরে । মিনিট খানেকের মধ্যেই ফিরে এসে দরজা আগলে বসে বললেন, ওসব হবে না । আমি পুরোটাই শুনবো । সেই প্রথম থেকে কি কি বলাবলি করেছেন সব ।
অগত্যা এরা দু’জনেও জাঁকিয়ে বসলেন গল্প করতে । একথা সেকথা হতে হতে ঘড়ির কাঁটাও পিছলে যেতে থাকলো স্বনিয়মে । সময় যে বসে নেই সে হুঁশও কারো নেই যেন । দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো । বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যে হবো হবো করছে ঠিক তখনই ফ্ল্যাটের আলোগুলো নিবে গেল দপ্ করে । এদের গল্পেও ছেদ পড়লো সেইসাথে ।
কুণ্ডুজায়া বলে উঠলেন, যাহ্, লোডশেডিং হয়ে গেল! ওদিকে কত্তা যে ঘরে একলাটি হয়ে পড়ে রয়েছেন বিছানায় । আয়াটিও আজ বাড়ি গেছে একবেলার ছুটি নিয়ে । যাই দেখি গিয়ে এতক্ষণে কোনও কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছেন কি না! কুণ্ডুজায়া হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন নিজের ফ্ল্যাটে ।
তাঁর চলে যাওয়াটা দেখতে দেখতেই রায়চৌধুরী গিন্নী মৃদু স্বরে বললেন, বেচারি । কি করে যে এখনো মাথা ঠাণ্ডা রেখেছেন তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন ।
মহুয়া শুনে অবাক হলেন, কেন দিদি ? কি এমন হলো যে ওকথা বলছেন ?
রায়চৌধুরী গিন্নী একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন, আর বলবেন না । দিদির কত্তাটি যে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে বিছানা নিয়েছেন সে খবর শুনেছেন ?
মহুয়া জবাব দিলেন, তা শুনেছি । তা তাঁর সেই অসুস্থতাটা কি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেছে ?
- বাড়াবাড়ি বলে বাড়াবাড়ি! আজকাল নিজে থেকে নড়াচড়াটুকুও করতে পারেন না । ধরে ধরে পাশ ফিরিয়ে দিতে হয় । দিন সাতেক আগের এক রাতে কি করে যেন বিছানা থেকে পড়ে গেছিলেন । কুণ্ডু দিদি এবং আয়া মিলে ওনাকে আবার বিছানায় তুলেছিলেন অনেক কষ্ট করে । কুণ্ড দিদি তারপর থেকে স্বামীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখেন খাটের সাথে । পাছে আবার পড়ে যান সেই ভয়ে । যে কেউ দেখলে ভাববে, কুণ্ডু বাবু বুঝি বাঁধাছাঁদা হয়েই অপেক্ষা করছেন কখন ডাক আসে ওপাড় থেকে । ডাক এলেই ‘বল হরি হরিবোল’ শুনতে শুনতে সোজা শ্মশানের পথ ধরবেন ।
৩১ জুলাই ২০১৫
------------------------------------------------------------------------------------
Contributed by Sudhansu Chakraborty in WaaS / July 2015
No comments:
Post a Comment