"); -->

Apr 29, 2015

ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে


|| ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে ||


(১)
অনেকদিন আগের কথা । সালটা বোধ হয় পঞ্চাশ দশকের শেষ বা ষাটের দশকের প্রথম দিকেই হবে । কোলকাতা উপকণ্ঠে এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম দক্ষিণ-পাড়া । আগে সব জমিদারেরা সেখানে ছিলেন । এখন তার কণামাত্রও অবশিষ্ট নেই । কিন্তু তাদের বংশ পরম্পরায় অনেকেই সেখানে বাস করেন ।

সেই বংশেরই এক সন্তান কেনারাম শর্মা । সজ্জন মানুষ । একটি বেসরকারি সংস্থার করণিক । মাহিনা সাকুল্যে আশী টাকা । চার ছেলে চার মেয়ে নিয়ে অভাবী সংসার । যৌবনে ফিজিওথেরাপি নিয়ে লেখাপড়া করেছিলেন । আর তারই সুবাদে এখন প্রতি রবিবার বাড়িতে চেম্বার করে রুগী দেখেন । মাঝেমাঝে বাইরে থেকেও ডাক আসে । ওনার অমায়িক ব্যবহারে সবাই ওনাকে খুব ভালোবাসেন । ডাক্তারির সুবাদে আশেপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামের মানুষ ওনাকে নামেও চেনেন ।

কেনারাম বাবুর ছেলেমেয়েরা মোটামুটি সবাই লেখাপড়া করে । দিন যায় মাস যায়, বয়স বাড়ে সবার । বড় মেয়েটা বিবাহযোগ্যা হয় । দেখতে খুব সুশ্রী । পাশের গ্রামের এক ভদ্রলোকের নজরে পড়ে যায় । পুত্রবধূ করার জন্য তিনি একদিন কেনারাম বাবুর বাড়িতে এসে প্রস্তাব দিলেন । কেনারাম বাবুও ওনাকে চিনতেন । ওনার ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার । চাকরী নয়, নিজেই একটি সংস্থা খুলেছে । পশার মন্দ নয় । আর তাই সম্বন্ধ পাকা হতে দেরী হল না । কিন্তু বিয়ে দেবেন সে ক্ষমতা কোথায় । অনেক ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করলেন বাড়ির পিছনের অংশটি বিক্রি করে দেবেন । আর সেই টাকায় বড় মেয়ের বিয়ে দেবেন ।

শুনে স্ত্রী মলিনা দেবী হাঁ হাঁ করে উঠলেন । তা কি করে হয় ; আরও তিনটে মেয়ে আছে । তাদের কথাও তো ভাবতে হবে । একদিন না একদিন তাদেরও তো বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে । তখন টাকা আসবে কোথা থেকে । না বাপু আমার এতে সায় নেই । তুমি অন্য কোন খান থেকে টাকার ব্যবস্থা করো ।
অত চিন্তা করছ কেন । দেখ, আমাদের চার ছেলে । আর আমার বড় ছেলে যথেষ্ট মেধাবী । দেখবে ও বড় হয়ে ঠিক সংসারের হাল ধরবে । সে ভরসা আমার আছে । তখন সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে । আর মাথার উপর তো ভগবান আছেন । তুমি চিন্তা করো না ।

বাড়ির পিছনের অংশটা বিক্রি হয়ে যায় নামমাত্র মূল্যে । পাড়ারই এক সম্পন্ন ব্যক্তি সুযোগ বুঝে দাঁও মারেন ।
যথা সময়ে বিবাহও সম্পন্ন হয় । বেশ কয়েক বছর কেটে যায় এরপর । বাজারে দেনা হয়ে গিয়েছিল অনেক । এতদিনে মিটিয়ে দিয়েছেন অনেকটাই, তবুও বেশ কিছু বাকী । চেষ্টা করছেন সংসার বাঁচিয়ে আস্তে আস্তে তা মিটিয়ে ফেলার ।
বড় ছেলেটি কলেজের পড়া শেষ করে কেন্দ্রীয় সংস্থায় চাকরী করে । মেজ ছেলে কলেজে পড়ছে । মেজ মেয়ে গত বছর ম্যাট্রিক পাশ করে বসে আছে । আর পড়েনি ।

একদিন মলিনা দেবী তার বড় ছেলেকে ডেকে বললেন, বাবা, এবার তো অমার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করতে হয় । অমা হল মেজ মেয়ের ডাক নাম । অমাবস্যার দিন হয়েছিল বলে তার ঐ নাম । ভাল নাম একটা আছে, সেটা থাক । আমরা ওকে অমা বলেই ডাকব ।
বড় ছেলে রাণা বলে, মা আমার তো সবে এক বছর হল চাকরী করছি । মাইনের সব টাকাই তো তোমার হাতে ধরে দিই । আর আমার তো জমানো কিছু নেই । আরও দু-তিন বছর না গেলে আমি তো অফিস থেকে লোন পাব না । তুমি আরও কিছুদিন সবুর করো ।

মলিনা দেবীর মাথায় চিন্তা ঢোকে, তারও তো জমানো কিছু নেই । সংসারের যা হাল, তার উপর দিন দিন খরচা বেড়েই চলেছে । কিছু যে জমাবো তারও তো কোন উপায় দেখছি না । মাথার উপর তিন তিনটি মেয়ে । রাণার বাবাও যেন কেমন উদাসীন । কিছু বললেই কখনও উপরওয়ালা দেখায়, কখনও ছেলেকে দেখায় ।

(২)
দক্ষিণ পাড়া রেল স্টেশনের উল্টো দিকে একটু ভিতরে একটি বিয়ে বাড়ি । বাড়ির মালিক বেশ অবস্থাপন্ন । দু-দুটো ইটখোলার মালিক । একমাত্র মেয়ে । তাই বেশ জাঁকজমক করেই বিয়ে হচ্ছে । ছেলেটিকেও বেশ ভালো পাওয়া গেছে । একটি বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার । দুকূলে কেউ নেই । মা এক বছর হল গত হয়েছেন । ওর এক বন্ধুর নিকট আত্মীয় । সেই সম্বন্ধটা করেছে । ছেলেটি দেখতেও খুব সুন্দর । সব বাবা-মাই ঠিক এইরকম জামাই চায় ।
লগ্ন রাত বারোটার পর । আটটার মধ্যেই বর চলে আসে । যথারীতি মা বরণ করে বরকে ঘরে তোলে । খুশীর আবহাওয়া চারিদিকে । আয়োজনের কোন ত্রুটি নেই । সাড়ে এগারোটার মধ্যেই খাওয়া দাওয়া পর্ব সমাপ্ত । চার পাঁচ জন বরের বন্ধু ছাড়া বাকী সব বরযাত্রী খাওয়াদাওয়া পর চলে গেছে । এছাড়া এখন বাড়িতে আছে, কিছু আত্মীয়-স্বজন আর পাড়ার ক’জন । তারা বিয়ে দেখবে বলে বসে আছে ।

রাত বারোটা নাগাদ ডাক পড়ে কনেকে বিয়ের পিঁড়িতে আনার । সবাই আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে । সবাই এসে জড়ো হয় ছাদনাতলায় ।  কিন্তু এ কী ? সাড়ে বারোটা বাজতে চলল, মেয়েকে আনছে না কেন ? মেয়ের বাবা উতলা হয় । চারিদিকে শুরু হয় চাপা গুঞ্জন । মেয়ের মা কাঁদোকাঁদো গলায় বাবাকে আড়ালে ডাকে, বলে,
--মেয়ে তো এ বিয়ে করবে না বলছে ;
--সে কী ? তার মানে ; কি হয়েছে ?
--ওর কে এক বন্ধু আছে, তাকেই ও বিয়ে করবে ।
--তা সেকথা আগে বলেনি কেন ? কি দরকার ছিল এভাবে লোক হাসানোর । আমার মান ইজ্জত সব ধুলোয় মিশে গেল । আমি এখন কি করি ।

এদিকে পুরোহিত ঠাকুর তাড়া দিচ্ছেন, কনে আনার জন্যে । আবহাওয়াটা থমথম করছে । কারুর মখে কোন কথা নেই ।
পাড়ারই এক বর্ষীয়ান ভদ্রলোক বঙ্কু বাবু তখনও বসে আছেন, বৌমার আবদার বিয়ে দেখে যাবে । তাই বিয়ের শেষে স্ত্রী আর বৌমাকে বাড়ী ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে ঘরের ভেতর এক সোফায় বসে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছেন । হটাত ওনার স্ত্রী এসে বলেন, জানো সর্বনাশ হয়ে গেছে । মেয়ে হটাত বেঁকে বসেছে । ওর নাকি কে ভাবের ছেলে আছে, তাকেই বিয়ে করবে ।
--সে কী ? কি হবে তাহলে । দেখি তো ।
মেয়ের বাবাকে আলাদা ডেকে বঙ্কু বাবু বলেন,
--কি হল ভাই ?
--দাদা আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে, কান্না ভেজা গলায় বলে মেয়ের বাবা ।
--কি হয়েছে আমায় খুলে বল ।
মেয়ের বাবা সবিস্তারে বলে সমস্ত ঘটনা । তারপর বলে, দাদা এবারে বলুন আমি কি করব । আপনি আমায় এই অসম্মানের হাত থেকে বাঁচান । যে ছেলেকে আমরা বরণ করে ঘরে তুলেছি, তাকে কোন মুখে ফিরিয়ে দেব । আমার মাথা কোন কাজ করছেনা, আপনি দাদা একটা কিছু ব্যবস্থা করুন ।
--দাঁড়াও দাঁড়াও, বর কি জানে ব্যাপারটা ?
--জানে ।
-- আমি এখন যা অবস্থা বুঝছি, তাতে ঐ বরের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে না । আর দিলেও তা সুখের হবে না । তাহলে একটাই উপায়, অন্য মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়া আর নাহলে বরকে ফেরত পাঠানো ।
--জানেন তো দাদা আমার একটাই মেয়ে ।
--তাহলে অন্য মেয়ের সন্ধান করতে হবে ... ।
--তা যা ভালো হয় দাদা আপনি করুন । আমি আর ভাবতে পারছি না ।
--তাহলে বরের সাথে আগে কথা বলা দরকার ।
মেয়ের বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্কু বাবু বরকে সবিস্তারে সব বলেন । তারপর বলেন এখন একটাই উপায় অন্য কোন মেয়ের সাথে তোমার ...আর বলতে পারেন না বঙ্কু বাবু । বর সব বুঝতে পারে, বলে আমি একটু আমার বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে নিই ।
খানিক বাদে আলোচনা সেরে বর জানায় সে রাজী, মেয়েটি যেন ব্রাহ্মণ হয়, আর দেখতে যেন সুশ্রী হয় ।
--ঠিক আছে বাবা ।

বঙ্কু বাবুর মনে পড়ে কেনারাম বাবুর কথা । ওনার তো অনেকগুলি মেয়ে । উনি কি রাজী হবেন না ? মেয়ের বাবা বঙ্কু বাবুর হাতদুটো চেপে ধরে বলেন, আপনাকে রাজী করাতে হবেই দাদা । কোন খরচ নেই তাদের । এমন কি আমার কাছে বেনারসিও আছে । এক কাপড়েই তাকে নিয়ে আসুন । এখানে সব মজুত আছে ।
--জানি না কি হবে । দেখা যাক মা দুর্গার নাম করে ।
রাত দুটোর সময় একটি প্লিমাথ গাড়ি এসে থামে কেনারাম বাবুর বাড়ির সামনে । অপরিচিত গাড়ি আর তার সওয়ারী দেখে রাস্তার কুকুর সজাগ হয় । বিরক্ত প্রকাশ করে ঘেউ ঘেউ ডাকে ।

বঙ্কু বাবুর ডাকে কেনারাম বাবু খুব সাবধানে দরজা খোলেন । পিছনে স্ত্রী আর বড় ছেলে । কোন কথা গোপন না করে বঙ্কু বাবু সমস্ত ঘটনা জানান । মেয়ের বাবা বলেন আপনাদের কোন খরচা নেই । মলিনা দেবী বলেন তা কি করে হয়, জানা নেই শোনা নেই, হুট করে বিয়ে । এ তো ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে ।
--আমায় বিশ্বাস করুন আপনারা, কোন বাপ কি তার মেয়ের জন্যে খারাপ জামাই পছন্দ করতে পারে । দয়া করে আপনারা না করবেন না । আমি বলছি আপনাদের মেয়ে খুব সুখী হবে ।
নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে ওরা অমাকে ডেকে তোলে । রাত তখন প্রায় আড়াইটে । থতমত অমা উঠে বসে । মায়ের কাছে সব শুনে, মায়ের আদেশ পালন করে শাড়িটা বদলে গাড়িতে উঠে বসে ।

সেই লগ্নেই বিয়ে হয়ে যায় ওদের । পাঠক-পাঠিকা কি ভাবছেন ? নিজের মেয়ের জায়গায় অন্যের মেয়ের বিয়ে দিয়ে কেউ কি কোন বাবা-মা সুখী হতে পারে । না তা হয়নি । মেয়ের মাও ইতিমধ্যে পাশের বাড়ী থেকে মেয়ের বন্ধুটিকে ডেকে নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছে । তাই একই লগ্নে দুটি বিয়ে হয় একই বাড়িতে ।
মধুরেণ সমাপয়েত......... ।

(নামগুলো পরিবর্তিত করা আছে । কিন্তু ঘটনাটা একদম সত্যি । একটা কথা বলি । অমার বিয়ের পর গঙ্গার ধারে ওরা একটা সুন্দর বাড়ি করে । খুব সুখী পরিবার ছিল ওরা । বছর ১০/১২ আগে ওরা চলে গেছেন । রেখে গেছেন দুই মেয়ে আর তিন নাতি নাতনি । মাস খানেক আগে এক মেয়ের সাথে দেখা হয়েছিল এক অনুষ্ঠানে ।)


-----------------------------------------------------------------------------
Contributed by: Aloke Chowdhury in WaaS / 29 April 2015

No comments: