"); -->

Jul 31, 2015

সোমনাথ চক্রবর্তী সংকলন – জুলাই

-------------------- সোমনাথ চক্রবর্তী সংকলন – জুলাই, ২০১৫ --------------------


|| নেমন্তন্ন ||


বাঙাল বাড়িতে লক্ষ্মীপূজোর খাওয়া
ধোওয়া আকাশ, হিমে ভেজা এক থালা চাঁদ,
খিচুড়িতে নারকোলের কুচি, 
ফুলকো লুচি
আর দুধ-সাদা পায়েসে মেরুনরঙের কিসমিস,
ছাদের কার্নিশে তখন নারকোল পাতায় গড়িয়ে গেলো রূপো ।

একটু রাতে তিনতলার ছাদে
উঠলো উতল হাওয়া,
ফুটফুটে চকখড়ির মতো আলোয় আলো ।
টুকটুকে আলতা পরা ছোট্ট দুটি পায়ের পাতা,
ডুরে শাড়ি আফগান স্নো, এলো চুলে কপালে কাঁচপোকা-টিপ,
ঠাকরুনের পাতলা ঠোঁটে চাঁদের কুচি মাতলা হাসি
কেমন আঁচল উড়িয়ে ঘুরে বেড়ান খুশিখুশি
এই না দেখে চুপিচুপি 
আপনমনে হাসনুহানা ফুটলো রাশিরাশি ।।

- ০১ জুলাই ২০১৫
-------------------------------------------------------------------

|| প্রিয় বন্ধুর গল্প ||


ছোটবেলায় ছিলো যৌথ পরিবারের আগলে রাখা জীবন
বড় বড় বনস্পতির আড়ালে
শ্যামল তরুশাখাটির মতো যত্নে বেড়ে ওঠা ।
জোরে ধমকে দিলে ছোট্ট বুকে চমকে উঠতো ভয়,
নবীন পাতায় সবুজ শিরায় ছিলো পাগলাঝোরার উচ্ছ্বাস ।

সেই সময়, ষোলো বছর বয়েসে
লম্বা বাহাদুর খাতার আড়ালে পেয়েছিলাম একটি বই,
শেষের কবিতা ।

আর যায় কোথায়, এ্যালজেব্রার ফর্মুলা বেমালুম ভুলে
ঝরঝরিয়ে পড়ে ফেলা হলো তক্ষুনি,
প্রেমটুকু হেসে ফুটলো বুকে
মনের তারে বাজলো শুধু মধুর সুরের গুনগুনানি,
সে বয়েসে বুকের একতারায়
বিয়োগব্যথার সুর ধরলো না মোটে ।
গ্রীষ্মের মধুর সন্ধ্যায় বা শীতের ঝলমলে দুপুরে
কোনও বনহরিণীকে পথে যেতে দেখলে
মনেমনে গেয়ে উঠতাম
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী,
বন্ধনহীন গ্রন্থি শব্দবন্ধের মানে যে কি
সঠিকভাবে বুঝতে তখনো শিখি নি ।

এরপর প্রেসিডেন্সির রেলিংয়ে
সারিসারি বইয়ের ফাঁক থেকে হঠাৎ একদিন 
উঁকি দিলো বন্ধু অমিত রায় ! হাতে তুলে দিলো ইসমাইল
তার দাড়িতে মেহেন্দি চোখে সুর্মা দাঁতে পানের ছোপ,
আর কোনও কথা নয় সোজা বগলদাবা করে বাড়ি ।

সেই থেকেই তো জড়িয়ে আছে সঙ্গে, 
কখনো চোখের জলে পাতা ভেজে
আবার খুশির দমকা হাওয়ায় আপনি শুকোয় ।

একেবারে নিজের লোক
তাই গ্রহণ করে যাই প্রতিদিন,
নিজেকে ঋণী মনে হয় না কক্ষনো !

- ০৩ জুলাই ২০১৫
-------------------------------------------------------------------

।। ফুড়ুৎ ।।


সেই মেয়েটি কবিতা লিখতো
পড়তে যেতো বুকের কাছে আগলে নিয়ে বই, 
দোলানো বেণীর ফাঁকে ফাঁকে জমে ওঠা অন্ধকারের চিরকালীন রহস্য । 

বাবার ছোট্ট মুদিখানার দোকান
অতিরিক্ত স্টক জমে থাকতো ঘরে
চাল, ডাল, তেল আর আলুর বস্তা ।

তার ফাঁকে
দেওয়ালের তাকে, ছেঁড়া ডাইরির পাতায়
শান্তিতে বাঁচিয়ে রাখতো কবিতার পলকা প্রাণ ।

এতো গান নয় যে কণ্ঠে বাজবে
নাচ ও নয় যে কেউ দুচোখ ভরে দেখবে,
এ তার বুকের গোপন ঘরে নিশ্বাসের তাপে
ফুটে ওঠা অরুণরঙা প্রাণজুড়নো ফুল,
যা আপনি হাসে কাঁদে আবার আপনি ঝরে যায় ।

এরপর যা হবার তাই হলো, 
বিয়ের পর ভোর থেকে অফিসের রান্না
দুপুরের ঘুমে রাতজাগা পুষিয়ে নেওয়া
সন্ধ্যেয় অন্তবিহীন সিরিয়ালের ফাঁকে, ধীরে সুস্থে
কালো মেঘের ভ্রুকুটির মতো তার শরীরে জমলো মেদ,

কবিতার তো একফোঁটা প্রাণ, 
তার দু'ডানায় মায়াভরা পালকের ত্রাণ
ওমনি ডানা মেললো আকাশে, ফুড়ুৎ !

- ০৭ জুলাই ২০১৫
-------------------------------------------------------------------

।। প্রকৃতির খেলা ।।


ফুলির বাড়িতে আজ মাংস রান্না হচ্ছে 
খোলার চাল বেড়ার ঘর, বর ভ্যান চালায়  ।
মাথাপিছু দশ টাকায় ওর ভ্যানে বসে
জলপথ পেরিয়েছে কাল কতো লোক ।

ফুলির ঘরে আজ হাসছে সকালবেলার ঝিলমিল রোদ, 
ঘুনসি পরা উদোম ছেলে
হা পিত্যেস করে বসে আছে ।
ফুলি আমার বাড়ি আজ কাজে আসে নি,
পায়ে পায়ে গিয়ে দেখলুম
বাড়ির মেঝে আর উঠোন দিয়ে বয়ে যাচ্ছে
ড্রেন ভাসা জলধারা, 
তক্তপোষের ওপর কেরোসিন স্টোভ,
তার ওপরে কড়ায় সেদ্ধ হচ্ছে মাংস
ড্রেনের গন্ধ ছাপিয়ে ভেসে আসছে মায়াবী রান্নার আকুল সুবাস ।
জলে জলে রক্তজল কাল সারা বেলা, 
আজ খুশি রাশিরাশি প্রকৃতির খেলা ।

- ১২ জুলাই ২০১৫
-------------------------------------------------------------------

|| বন্ধুর পথে বন্ধুর সাথে ||


ভাল্লাগেনা সুইচ টিপে বন্ধু হতে
আঙুল দিয়ে দুঃখ ছোঁয়া যায় কি তাতে ?
সুখের ঘরে হাজার বাতি রোশনি জ্বালে
দুখের দিনে মোমবাতিটা একলা হাতে ।

হৃদয় জুড়ে পেলাম সাড়া গভীর রাতে
পদব্রজে মিলতে হবে তোমার সাথে,
ভোরের আলো প্রাণ জুড়োলো তোমার গানে
শিউলি বকুল সে গান শুনে আপনি মাতে ।

জীবন যেন হারিয়ে ছাতা বৃষ্টি ভেজা
চোখের কোলে প্লাবন এলে যায় না বোঝা,
মরণ এসে চরণখানি চিনিয়ে দিলে
সাঙ্গ হবে আকুল চোখে বন্ধু খোঁজা ।।

- ১৩ জুলাই ২০১৫
-------------------------------------------------------------------

।। চুমকির বাবার গল্প ।।


সাউথ পয়েন্টার চুমকি লং স্কার্ট পরে স্কুল থেকে ফিরতো । বাস থেকে নেমে সোফায় ছুঁড়ে দিতো স্কুল ব্যাগ । তারপর ফ্রিজের জল মুখেচোখে ঝাপটা দিয়ে মাটিতে থাবড়ি খেয়ে বসে খাওয়া হতো দুধের সর চালের ভাত, মৌরি ফোড়ন দেওয়া বিউলির ডাল আর সাধের আলুপোস্ত । পোস্ত চুমকির খুব প্রিয় । একদিনও বাদ গেলে রাতে স্বপ্ন দেখতো ভুতের রাজার বরে থালার ওপর টপাটপ ঝরে পড়ছে পোস্তর বড়া । খাওয়া হয়ে গেলে চুমকি ছাদে উঠতো ঘুড়ি ওড়াতে ।

আমাদের চুমকির চমকানো রেজাল্ট, টিকালো নাক, পিঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া শ্যাম্পু করা চুল আর বিদ্যুতের ঝিলিক মারা চোখ দেখে মুণ্ডু ঘুরে যেতো পাড়ার বেপাড়ার সব ছোঁড়াদের । কিন্তু ঐ ঘোরাঘুরিই সার । চুমকির বাবা ভবেশ বাবু জাঁদরেল
আইপিএস অফিসার । হেঁজিপেঁজি ছেলে তার মোটেই পছন্দ নয় । অতএব চলতে লাগলো বাবা মায়ের ছেলে খোঁজা আর মেয়ের কলেজের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ফুচকা চুরমুর ঘটি-গরম । এমনি করে ফুরফুরিয়ে কখন গড়িয়ে গেলো বছর । শাড়ি পরে কলেজে যাওয়ার দিনও দিনের নিয়মে শেষ হলো ।

অনেক দেখেশুনে খুঁজেপেতে ছেলে পছন্দ হলো ভবেশ বাবুর । আমেদাবাদে মাল্টিন্যাশনালে বড়ো চাকুরে । মা কাঁদলো খুব । একটা মোটে মেয়ে, তাকে অত দূরে পাঠিয়ে দেবে ? বাবা গোঁফে তা দিয়ে বললে, কিচ্ছু করার নেই । অনেক কষ্টে এমন ভালো ছেলে পেয়েছি, আর হাতছাড়া করতে চাইনে । 

এরপর যথারীতি ম্যারাপ-সানাই আর আমাদের নেমন্তন্ন। হন্তদন্ত হয়ে বুক ফুলিয়ে ছুটোছুটি করলেন কর্তা । সকলকে ডেকে ডেকে দেখালেন তার কৃতি জামাই । আমাদের পাতে পড়লো চিকেন ভর্তা আর রসোমালাই । পরের দিনই উড়ান । মায়ের চোখে উথলানো জল । মেয়ের বাবা পুলিশ অফিসার, মন খুব শক্ত । বোঝালেন, মেয়ে সন্তান ঘরে রাখার নয়। দেখেশুনে এমন বিয়ে তাইতো দিতে হয় । সন্ধ্যের পর আমরা দেখলাম ঘর অন্ধকার, একটি জানলার ফাঁক দিয়ে তেরছা ম্লান আলো এসে পড়েছে বাগানে । যে বাড়ি ছিলো গতকাল হাসি-গান কোলাহল মুখর, আজ তা স্থির, শান্ত, যেন ধ্যানমগ্ন । 

পরের দিন একটু বেলায় ব্যাগ হাতে রিক্সা করে ভবেশ বাবু চললেন বাজারে । মনেমনে হিসেব করলেন আর কতদিন এই ঘানি টানতে হবে । রিটায়ারমেন্টের কতো দেরি আর । ব্যাগ আর ফর্দ দোকানিকে ধরিয়ে দিয়ে কাগজের হেডলাইনে মন দিলেন। ভাবলেন, তেলেভাজার অনুসারী শিল্প কি কি হতে পারে । দোকানি মাল-ভর্তি ব্যাগ বাড়িয়ে দিয়ে বললে, একটা ভুল হয়ে গেছে কাকু, পোস্তটা লেখেন নি । কর্তা মশায়ের গোঁফ পড়লো ঝুলে, চশমা উঠলো ঝাপসা হয়ে, জুলফিতে জমলো বিন্দু বিন্দু ঘাম । তাড়াতাড়ি পকেট থেকে টাকাপয়সা বের করে দিলেন । বললেন, না না, পোস্ত দিস না ডাক্তারের বারণ ।


ব্যাগ বেশ ভারি । চালডাল বেশি করে নিয়েছেন । রোজরোজ বাজার যেতে ইচ্ছে করে না আর । ম্লানমুখে ক্লান্ত পায়ে রিক্সার দিকে এগিয়ে গেলেন । দখিন হাওয়া এসে ভালোবেসে ঝাপটা মারলো তাঁর ঘামে ভেজা মুখে ।

- ১৭ জুলাই ২০১৫
-------------------------------------------------------------------

|| নক্ষত্রখচিত ডাউনটাউন ||


গতকাল ডাউনটাউনে ছিলো নক্ষত্রের মেলা 
আকাশ তাই মেঘলা ছিলো না,
দীর্ঘদিন ওভারটাইম খাটার পর মেঘদের হয়ে গেলো হঠাৎ ছুটি ।
তারা সব দল বেঁধে উড়ে চললো
তাদের ঘরবাড়ির দিকে, কোথায় কে জানে !

এদিকে জগতের নাথ তখন তৈরি হচ্ছেন বাৎসরিক ভ্রমণের জন্যে
তাঁর ধাক্কা দেওয়া জরিপাড় ধুতি
একগাল হেসে কুঁচিয়ে দিচ্ছে বাতাস,
আকাশকে ডেকে বললেন হ্যাঁরে গণু, আমার রাস্তা ধুয়ে দিলি না ?
আকাশ বললে প্রভু, আজ যে নক্ষত্র সমাবেশ ডাউনটাউনে
সেই আলো নাকি পৌঁছে যাবে সাগরপারে দেশবিদেশে,
মেঘদের তাই দিয়ে দিলাম ছুটি ।

কিন্তু তাঁর যে সময় নেই
তাঁকে আজ তাঁর বিশাল সুগোল নয়নে দেখে নিতে হবে সব
প্রাচুর্যের চকমকির পাশে চোখের জলের বন্যা,
আলোর ঝলকানির নীচে অন্ধকারের ঘনঘটা ।
তাঁকে এক হাত বোলাতে হবে কচি শিশুর অঙ্গুষ্ঠ হারানোর বেদনায়
অন্য হাত রাখতে হবে বাস থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া
প্রতিবন্ধীর একলা কাঁধে ।
তাই সন্ধ্যারানীর হাতে জ্বললো প্রদীপ
বেজে উঠলো মঙ্গলশঙ্খ,
রথ চললো ঘরঘরিয়ে ।।

- ১৮ জুলাই ২০১৫
-------------------------------------------------------------------

|| জীবনের অঙ্ক ||


প্রোমোশন পেলে তোমাকে আনবো ঘরে, 
ঠিক দুক্কুরে বাথরুম থেকে ভেসে আসবে বিদেশি শ্যাম্পুর ঘ্রাণ
রান্নাঘর থেকে বেডরুম থেকে ঠাকুরঘর থেকে ছাদে ।
খুন্তিটা কি করে আজ হঠাৎ উঠে এলো মার হাত থেকে
তোমার দুটি হাতে, বাটামাছে ধনেপাতার ঝাল রাঁধছো
মিনি বেড়ালটা অবাক চোখে তাই দেখবে ।
একের পর এক সারাদিন তোমার সুরভিত উপস্থিতি বাতাসে, 
পাশের বাড়ির ঠাকুমার মনে পড়ে যাবে
ছোটবেলার হারানো সব দিন ।

সন্ধেবেলা চায়ের তরলে চিনি-দুধের গোপন মিশেলে
কিসের যেন আভাস, নিঃশব্দ আমন্ত্রণ, মাতাল রাত । 
শুধু আজীবন কলুর বলদ, প্রতিদিন পদত্যাগপত্র
কুচিকুচি হয়ে উড়ে যাবে হাওয়ায় হাওয়ায়, যন্ত্রণায় !

- ২২ জুলাই ২০১৫
-------------------------------------------------------------------

|| জীবনের অঙ্ক (দুই) ||


অফিসের ট্রামের জানলা দিয়ে রূপসী কদমফুল
কতবার ডেকে গেছে রোজ,
আহা সেই বৃষ্টির নির্জন পার্কের ঝুরিনামা বটগাছে
মেঘলা ছাতার আশ্রয়,
খোট্টার দোকানের মশলা চা আর রিমঝিম শ্রাবণ দুপুর
কতদিন ভালোবেসে হাতছানি দিয়েছে আমায় ।

মিনিবাসের জানলায় ময়দানের নবীন সবুজ কার্পেট
তার নীচে জলে পা ডুবিয়ে মুখ ফিরিয়ে হাঁসের মতো
হেঁটে চলে গেছে দু'জোড়া পায়ের পাতা,
বিদ্রূপে আর অহংকারে, শুকনো ডাঙ্গার দিকে,
যেখানে কোলের ওপর ঢালা হবে চীনেবাদাম, হাতে থাকবে
কাগজে মোড়া বিটনুন, সবুজ রঙের । 
সেইসব দিনে রোজ কান ধরে নিয়ে গেছে ডিপোজিট টার্গেট
রক্তচক্ষু ভুতের হিসেব ।

আজ খাঁচা খুলে দিলে অকারণ দলছুট ডানাভাঙা প্রাণ 
ক্ষীণদৃষ্টি ঘ্রাণশক্তি ম্লান হয়ে এতদিনে হয়েছে ফিনিশ,
কদমফুলকে দেখে চোখ ফেটে জল আসে, 
মনে হয় একে নিয়ে
লোফালুফি খেলা হোক টেবিল টেনিস ! 

- ২৪ জুলাই ২০১৫
-------------------------------------------------------------------

|| জীবনের জলরঙ ||


বিপদসীমার ওপর দিয়ে অবিরাম বয়ে যাচ্ছে জল
কার বিপদ ? লুঙ্গি পরা দোকানিরা হাসিমুখে হাতে দিচ্ছে রঙিন তরল, 
ভারি পর্দা ঠেলে দিলে
কাঁচের সার্সির গায়ে হিরের কুচির ধারাপাত,
পর্দা ফের টেনে দেবে অফিস ফেরত সন্ধ্যায়
টেবিলে সাজিয়ে নেবে গ্লাস ।

নয়তো আকুল চোখে
খুঁজে দেখো যদি পাও ইলিশ মাছের প্রিয় ডিম
চলুক না রিমঝিম আকাশের মেঘমল্লার,
আজ রাতে, গরম ভাতের সাথে
যত্ন করে ভেজে দিয়ো পাতে ।
চারিদিকে এতো জল হবে নাকো নিষ্ফল
প্রিয়জন যদি থাকে সাথে ।

আকাশ যে ভুলে গেছে রোজ রাতে খোড়ো চালে ভেসে যাচ্ছে ঘর
টিনের সুটকেসে আর মাটির ভাঁড়েতে আছে টাকা,
রঙিন স্বপ্নের ঘোরে কেটে যাক কটা মোটে জলে ভেজা দিন
আকাশের আলো পেলে, 
খড়কুটো ফেলে দেবে হবে ঢেউটিন !

- ২৮ জুলাই ২০১৫
-------------------------------------------------------------------

|| স্মৃতির ঝাঁপি ||


সভ্যতার ঊষালগ্নে শ্বাপদসংকুল পরিবেশ আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্যে মানুষ জোটবদ্ধ হয়েছিলো ।  তারই ধ্বংসাবশেষ মনে হয় আমাদের ছোটবেলার সেই যৌথ পরিবার । সে এক সুপরিচালিত, ছন্দোবদ্ধ, স্বপ্নময়, প্রাণবন্ত সংসার যার সর্বময়ী কর্ত্রী ছিলো আমার ঠাকুমা । বাড়ির জ্যেষ্ঠ সন্তান, কর্মকুশলতার জন্যে সাহেবের সুনজরে থাকা সেকশন ইন-চার্জ ঠাকুমার কাছে শুধুই বড়ো খোকা । দৈনন্দিন কাজেকর্মে বাড়ির বৌগুলো সব দাসীবাঁদী কিন্তু দুর্দিনে, বিপদে, রোগভোগে তারাই আবার পেটের মেয়ে । আজকের ঝাঁ চকচকে বি-স্কুল গুলো গেস্ট লেকচারার হিসেবে অনায়াসে তার কাছ থেকে প্রশাসনের পাঠ নিতে পারতো কিন্তু হায়, সেই বুড়ি আজ কোথায় !

একবার বাড়ির কনিষ্ঠতম শিশুকন্যাটি দিদির সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে আচমকা উন্মুক্ত ড্রেনে পড়ে যায় । পাড়ার ডাক্তারবাবু তৎক্ষণাৎ তাকে হসপিটালে স্থানান্তরিত করার উপদেশ দেয় । সেদিন ট্রেন বন্ধ, মেয়ের বাবা ট্রামে-বাসে ঝুলে অফিসে পৌঁছে নিশ্চিন্তে খোশগল্পে মগ্ন । ঠাকুমা একা মেয়ে কোলে করে হাত দেখিয়ে মালগাড়ি থামিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে ডাক্তারের আশ্বাস পাবার পর মেয়ের বাবার কাছে খবর যায় । বিষয়টিতে ঠাকুমার হস্তক্ষেপের কথা শোনার পর তিনি সন্ধ্যাবেলা ধীরেসুস্থে মেয়েকে দেখতে আসেন ।

ঠাকুমার হাতের নাড়ু ছিলো অসাধারণ । ঘরে জ্বাল দেওয়া ক্ষীর, বাটা নারকোল, সুজি আর ছোটো এলাচের সুগন্ধে স্বর্গীয় কড়াপাক । দৈবাৎ কোনও সুযোগে তা চুরি করে খাওয়ার স্বাদ হঠাৎ মনে পড়ে গেলে আজকের শিশুদের মলিন মুখও যেন
একই সাথে পাশাপাশি অবিকল ভেসে ওঠে, দুর্নিবার চোখের জলে । লন্ঠন দেখলে আজও ঠিক মনে পড়ে যায় তার নরম আলোয় ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়া মণিমুক্তোর মতো অমলিন গল্পগাথা । হায়, আজ সেইসব ঝুলি হীন ঠাকুমারা হয়তো ভাগের মা, নয়তো বৃদ্ধাশ্রমে চোখের জলে দিন গুনছেন ।

ঠাকুমার রাজত্বে মেয়েদের ছিলো বিশেষ যত্ন আর আগলে রাখা আদর । তাদের জন্যে সবসময় দু’পিস মাছ। তারা যে পরের ঘরে যাবে, চেয়ে খেতে পারবে না, তাই । এই নিয়ে ছেলে মহলে চলতো জরুরি বৈঠক । কে কবে কোন চুলোয় যাবে তার জন্যে এই অসাম্য সহ্য করা বড়ো কঠিন ছিলো । তাই দুষ্টু দাদাটি চিলের মতো গভীর নিষ্ঠায় আপাত নিরীহ মুখে পাশে খেতে বসলে, মুহূর্তের অসাবধানতায় এক পলকে হয়ে যেতো এক পিস মাছ উধাও । তাই নিয়ে নিরন্তর চুলোচুলি চোখের জল খুশি আনন্দ আর হুল্লোড়ে গমগমিয়ে উঠতো সারা বাড়ি। কিংবা হয়তো সারা পাড়া ! 

(রচনাটিতে দুজন ঠাকুমা আছেন । আমার এবং আমার গৃহিণীর ।)

- ৩০ জুলাই ২০১৫

---------------------------------------------------------------------------------------
Contributed by: Somnath Chakraborty in WaaS / July 2015

No comments: